অন্যদের কথা না হয় না-ই বলা হোক, অন্তত নিজের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আপনারা সকলেই অনুভব করতে পারেন। সেটা হলো একেক সময়ে আপনার আচরণ একেক রকম হয়ে থাকে। আপনার মুডের উপর নির্ভর করে আপনার দৈনন্দিন কাজকর্ম আর আচার ব্যবহার কেমন হবে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আরেকটি ব্যাপারও লক্ষণীয়। সেটা হলো দিন দিন আপনার আচরণও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে হয়তো। আগে কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটলে যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতেন, এখন হয়তো আর সেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখান না। কিংবা আগে অন্য কারো সমস্যায় যেভাবে উদগ্রীব হতেন বা সাহায্যে এগিয়ে আসতেন এখন আর সেভাবে এগিয়ে আসেন না।

এসবের কারণটা কী? মোটা দাগে চিন্তা করলে অনেকেই হয়তো চট করে এই কার্যকারণের কথাই বলবেন যে, প্রতিনিয়ত নানা প্রকার ঝুট ঝামেলা পোহাতে পোহাতে আমাদের অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে, যাবতীয় সমস্যাগুলো অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে বা সব কিছুতেই একটা সহনীয় মাত্রা চলে এসেছে। ফলে কেউই আর আগের মতো প্রতিক্রিয়া দেখান না।
নিঃসন্দেহে এটি একটি চিন্তার ব্যাপার। কারণ কারো বিপদে আশেপাশের মানুষের উদগ্রীব হওয়া এবং সেটা থেকে সাহায্যে এগিয়ে আসাই স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া হয়। নতুবা ‘সমাজ’ জিনিসটারই ভিত্তি থাকে না। কিন্তু এ জাতীয় আচরণ আমাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত আরো গেড়ে বসছে। হুমায়ূন আহমদের ‘হিমু’ সিরিজের একটি উপন্যাসে তিনি বলেছিলেন, মানুষের অবাক হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। ঘটনাটা ছিলো এরকম যে, হিমু একবার গরম কালের তীব্র গরমের মধ্যে মোটা উলের টুপি পরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। স্বভাবতই এই উদ্ভট পোশাকের কারণে আশেপাশের মানুষের অবাক হয়ে কিছুটা কৌতুহলী দৃষ্টি দেয়ার কথা। কিন্তু কেউ ফিরেও তাকায়নি।
এখন যে প্রশ্নটা নিয়ে আজকের এই আলোচনা সেটা হলো অন্যের সমস্যায় আমাদের এই নিষ্ক্রিয়, নির্লিপ্ত আচরণ কি শুধু এই ঘটনার পুনরাবৃত্তির কারণে? একটা সমস্যা বারবার চোখের সামনে দেখতে থাকলে শুধু তাতেই কি এটা ঘটে? নাকি এর বাইরেও আরো কারণ আছে এর পেছনে। হ্যাঁ, আরো কারণ আছে এর পেছনে। অন্তত সাম্প্রতিক গবেষণা সেটাই বলছে।
সিনেমা-নাটক দেখা বা কোনো উপন্যাস পড়ার সময়ে আমরা আমাদের প্রিয় চরিত্রগুলোকে কষ্ট পেতে দেখলে সেজন্য সহানুভূতি (Empathy) অনুভব করি। অন্যকে কষ্ট পেতে দেখলে আমাদের নিজেদের মস্তিষ্কের যে অংশটা ব্যথা অনুভব করায় সেটা এক্ষেত্রেও সক্রিয় হয়ে ওঠে।
কিন্তু আমরা ঠিক কতটা বা কী পরিমাণ সহানুভূতি অনুভব করব সেটা নির্ভর করে আমাদের মানসিক অবস্থার উপর। আমাদের আবেগ আক্ষরিক অর্থেই আমাদের মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে কিভাবে আমরা এসব ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দেখাব তার উপর। হয়তো ভাবতে পারেন, এ আর নতুন কী? কিন্তু এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমাদের সামাজিক জীবনে রয়েছে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব।
আমাদের মুড আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করে বহু দিক থেকে। যেমন- খাদ্যাভাসের কথাই ধরুন। আমরা যখন খারাপ মুডে থাকি, তখন আমরা খাওয়াদাওয়ায় বেশ অনিয়ম করি। মুড খারাপ থাকলে বন্ধুত্বেও প্রভাব পড়ে। আমাদের দলে কোনো বন্ধু যদি নিরাশ ও মনমরা হয়ে থাকে, তবে দলের বাকিদের উপরও তার প্রভাব পড়ে। ২০১৭ সালের এক গবেষণায় পাওয়া গেছে, এই খারাপ মুড শুধু বন্ধুদের সাথে আড্ডা থেকেই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দ্বারাও ছড়াতে পারে!
মন খারাপ ভাব শুধু বন্ধুদের আড্ডা থেকেই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দ্বারাও ছড়াতে পারে! Source: cmch.tv
আমাদের আবেগ অনুভূতির শক্তি এতটাই বেশি যে, এটা আমাদের শারীরিক জখম বা ব্যথার অনুভূতিকেও কমিয়ে দিতে পারে, অনেকটা ব্যথানাশক ওষুধের মতো। যে কারণে অনেক ডাক্তার শিশুদের ইঞ্জেকশন দেয়ার সময় হাসানোর চেষ্টা করেন। আবার নেতিবাচক আবেগের কারণে ঘটনা উল্টোও হতে পারে। অর্থাৎ সামান্য জখম বা ব্যথা মেজাজ খারাপ থাকার কারণে তীব্র মনে হতে পারে।
২০১৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে দেখা যায়, আমরা যখন খারাপ মেজাজে বা শারীরিক যন্ত্রণায় থাকি, সেটা আমাদেরকে অন্যের বিপদে সাড়া দেয়ার ক্ষমতাকে কমায় এবং আক্ষরিক অর্থেই সহমর্মিতা অনুভবে বাধা দেয়। জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এমিলি কিয়াও তাসেরি এবং তার দল গবেষণা করে এটা দেখতে চাচ্ছিলেন যে, শারীরিকভাবে যন্ত্রণায় থাকাবস্থায় আমাদের আবেগের অবস্থা কেমন থাকে এবং এ অবস্থায় অন্যের বিপদে তারা কিভাবে সাড়া দেয়।
তারা যে পদ্ধতি অবলম্বন করলেন সেটা হলো, কিছু স্বেচ্ছাসেবক বাছাই করে তাদের প্রত্যেকের পায়ে তাপ প্রদানকারী একটি যন্ত্র বা ডিভাইস সংযুক্ত করা হলো। এই যন্ত্রটি নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রত্যেকের পায়ের গরম তাপ দিয়ে কিছুটা শারীরিক অস্বস্তি তৈরী করবে। এ অবস্থায় তাদেরকে একটি ব্রেন স্ক্যানারে রেখে নেতিবাচক ও ইতিবাচক কিছু ভিডিও ক্লিপ দেখানো হলো।
এ পরীক্ষায় কিছু ফলাফল পাওয়া গেল। স্বেচ্ছাসেবকদেরকে শারীরিকভাবে যন্ত্রণা (ডিভাইসের মাধ্যমে) দেয়ার পর কিছু ভিডিও ক্লিপ দেখানো হলো। কোনো ভিডিওতে আমরা যদি কাউকে নির্যাতন করা বা বিভৎস কিছু দেখি, তাহলে স্বভাবতই শিউরে উঠি। কারণ এরকম কিছু দেখলে আমাদের মস্তিষ্কের যে অংশটা ব্যথা অনুভবের জন্য দায়ী, অর্থাৎ Anterior insula এবং Middle cingulate cortex এই দুই অংশ সক্রিয় হয়।
স্বেচ্ছাসেবকরা নিজেরাও কিছুক্ষণ আগে কিছু শারীরিক যন্ত্রণায় ছিলো। ফলে তাদেরকে যখন অন্য কেউ যন্ত্রণায় আছে এমন ভিডিও দেখানো হলো তখন তাদের মস্তিষ্কের সেই বিশেষ দুই অংশে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। ফলে এই পরীক্ষায় এটা গবেষকরা প্রমাণ পেলেন যে, নেতিবাচক আবেগ আমাদের মস্তিষ্কের অবস্থাকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। এই পরীক্ষা থেকে তারা আরো একটা ফলাফল পেলেন, তা হলো নেতিবাচক ভিডিও দেখার পর স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে একটি প্রবণতা লক্ষ্য করলেন। একজন মানুষের চেহারার স্বাভাবিক অভিব্যক্তিকেও তারা নেতিবাচক অভিব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই প্রবণতার নাম দেয়া হয়েছে Empathic Distres
পরীক্ষার ফলাফলটি কি একটু দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে? একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা সহজ করা যাক। ধরুন, আপনার অফিসের বস তার ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক কোনো অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। হোক সেটা খুবই ছোট কিছু, যেমন নেতিবাচক কোনো সিনেমা দেখে অফিসে এসেছেন সকালে। এতে তার কোনো সহকর্মী যদি বিপদে বা ঝামেলায় পড়েন, সেক্ষেত্রে তার সহযোগিতাপরায়ণ হওয়ার সম্ভবনা কম। পশ্চিমা দেশের তরুণদের ভেতর একটি ঠাট্টা-মশকরা প্রচলিত আছে। সেটা হলো- “আমার ব্যক্তিত্ব নির্ভর করে আমার দেখা সর্বশেষ সিনেমা কী ছিলো তার উপর!”
২০১৬ সালের আরেক গবেষণায় দেখা যায়, এই Empathic distress এ আক্রান্ত হলে ব্যক্তির আগ্রাসী ভাব আরো বেড়ে যায়। এখানে কয়েকজন ব্যক্তিকে একসাথে ঝামেলাজনক পরিস্থিতে ফেলা হয়। এরপর প্রত্যেককে সুযোগ দেয়া হয় যারা তাদেরকে ঝামেলায় ফেলেছে তাদেরকে শাস্তি বা ক্ষমা করে দেয়ার। এক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বভাবত যারা দয়াশীল ও ইতিবাচক মনোভাবের, তারা অপেক্ষাকৃত ভালো আচরণ করেছে।
তো এই গবেষণার ফল হিসেবে বলা হয়েছে, উপযুক্ত পরিবেশ দেয়া হলে মানুষের দয়াশীল আচরণকে আরো বাড়ানো সম্ভব। এটাও বলা হয়েছে যে, মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও বাড়ানো সম্ভব।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা এবং দুটি গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল থেকে আমরা এটা বলতে পারি- আমরা যদি মনের ভেতরে কিছুটা ইতিবাচক চিন্তা জায়গা করে দিই, তাহলে খুব সহজেই আমরা আমাদের সহযোগিতামূলক আচরণকে বাড়াতে পারি।
আরেকটা ব্যাপার হলো, এরপরে আপনি যখন কোনো নেতিবাচক উপন্যাস পড়বেন বা কোনো হরর সিনেমা দেখবেন, তখন একটু বুঝে-শুনে বিজ্ঞতার সাথে সেটা করার চেষ্টা করবেন। কারণ মেজাজ খারাপ অবস্থায় সেটা করলে আপনার মস্তিষ্কের অবস্থাতেও সেটার প্রভাব পড়তে পারে